বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ভাতিজা বল্টুর অযুক্তিক প্রশ্ন

ভাতিজা বল্টুর অযুক্তিক প্রশ্ন
ইন্দ্রজিৎ ইমন

আমার ভাতিজার নাম বল্টু। না না, বল্টু নামটি তার বাবা-মা কর্তৃক দেওয়া কোন নাম নয়। এই নামটি হয়েছে তার স্বভাব সুলভ কথাবার্তা মানে প্রশ্নবাণের কারণে। বল্টু যাকেই কাছে পায় তাকেই একের পর এক এমন সব অযুক্তিক প্রশ্ন করে যে যাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে তার মাথার সব নাট-বল্টু নড়ে যেতে বাধ্য। এর ফলশ্রুতিতে কে বা কারা তার এই নামটি দিয়েছে আমাদের তা জানা নেই। তবে এই নামেই এখন সে সবার কাছে পরিচিত। তার ভাল নাম পুলক। পুলক নামে অবশ্য কেউ তাকে চিনে না। এমন কি তার স্কুলের বন্ধু-বান্ধবও না। পুলক নামটি শুধু ব্যবহৃত হয় স্কুলের হাজিরা খাতায় আর পরীক্ষার খাতায়। এখন আসি মূল প্রসঙ্গে। সেদিন গিয়েছিলাম ঢাকায় বাংলা একাডেমী কর্তৃক আয়োজিত বইমেলায়। সঙ্গে ছিল বল্টু। বল্টুকে অনেকটা বাধ্য হয়েই সঙ্গে নিতে হয়েছে। নয়তো মান- কুল সবই হারাতাম।কারণ আমি যে মাঝে মাঝে ভাইয়ার মানিব্যাগ থেকে টাকা ঝেড়ে দেই সেটা একমাত্র বল্টুই জানে। আর সে কিনা এই সুযোগটাই নিল! বলল, তাকে যদি মেলায় নিয়ে না যাই তাহলে সে তার আব্বুর কাছে এই গোপন তথ্যটা ফাঁস করে দিবে। অগত্যা কি আর করা? বিপদটাকে সঙ্গে করেই মেলার যেতে হলো। তবে তাকে একটা কন্ডিশন দিয়ে দেই যে কোন রকম প্রশ্ন করা যাবে না। বল্টু খুশিতে টইটম্বুর হয়ে কন্ডিশনে রাজি হয়ে যায়।
কিন্তু বল্টু যে কোন কন্ডিশনেরই ধার ধারে না তা আমি বইমেলায় গিয়েই বুঝতে পারলাম। মেলায় ঢুকেই বল্টু অবাক। আমাকে বলল,ছোটকা, চড়কা নাই, নাগরদোলা নাই এইটা আবার কেমন মেলা? আমি হেসে বললাম, এইটা হচ্ছে বইমেলা। এইমেলায় ঐসব থাকে না। আমার কথা শুনে যতটুকু পারা যায় তার চেয়ে কয়েকশ গুণ বেশি পরিমাণ বিরক্তির ভাব চেহারায় এনে সে বলল, দূর, আমি ভাবলাম মেলায় যাবো, চড়কায় চড়ব,বাঁশি-বেলুন কিনে বাসায় নিয়ে যাবো। কিন্তু তা না, এইখানে নাকি কিছুই পাওয়া যায় না। আচ্ছা ছোটকা, এই মেলাকে বইমেলা বলা হয় কেন? আমি বললাম, কেন আবার, এখানে বই পাওয়া যায়। তাই, এই মেলাকে বইমেলা বলে। বল্টু আবার জিজ্ঞেস করে,তাহলে বাণিজ্যমেলায় কি বাণিজ্য পাওয়া যায়? আবার বউবাজারে নিশ্চয়ই বউ কেনা-বেচা হয়, তাইতো? আমি চোখ বড় করে বল্টুর দিকে তাকাই। বল্টু তৎক্ষনাৎ চুপ হয়ে যায়। আমি যে তার উপর রাগ করছি বুঝতে পারে। বিষয়টা স্বস্তিকর। আমিও স্বস্তি পাই। কিন্তু আমার এই স্বস্তি খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। খানিক পরেই আবার শুরু হয় বল্টুর প্রশ্নবাণ।

এক স্টলের সামনে প্রচুর লোক সমাগম দেখে বল্টু আমাকে বলল,ছোটকা,ঐ স্টলে এতো ভিড় কেন? আমি বললাম, জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক 'কুদ্দুস আহমেদ' তার ভক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছে।বল্টু তার শুনে বলল, ছোটকা, আমি অটোগ্রাফ খাবো। আমার বেশ বেগই পেতে হলো বল্টুকে বুঝাতে যে অট্রোগ্রাফ কোন খাবার জিনিস না। তবে বল্টু আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেছে বলে আমার মনে হলো না। কারণ কেমন জানি সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি ওকে তোয়াক্কা না করে এক স্টলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বিভিন্ন বই নাড়াচাড়া করে দেখছি। তারপর এইস্টল সেইস্টল ঘুরে বেশ কিছু বই কিনলাম। সেগুলোর মধ্যে ছিল একটা বই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের উপর। বইটি বল্টুকে দেখিয়ে বললাম,এই বইটা পড়লে তুই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সর্ম্পকে অনেক কিছু জানতে পারবি,বুঝলি? কথাটা বলে যে আমি কি পরিমাণ ভুল করলাম তা টের পাই সঙ্গে সঙ্গে। বল্টু আমাকে জিজ্ঞেস করল, ছোটকা, ভাষা আন্দোলন কি? আমি খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললাম,তা-ই জানিস না, আশ্চর্য! যাই হোক, শোন, ১৯৫২ সালে 'রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই' এই দাবিতে সে আন্দোলন হয়েছিল সে আন্দোলনটা হলো ভাষা আন্দোলন। নিজ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই আন্দোলন হয়েছিল বলে এই আন্দোলনটাকে আমরা ভাষা আন্দোলন বলি। ৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষার দাবিতে রাজপথে নেমেছিল মিছিল। আর সেই মিছিলে লাখ জনতার ঢল নেমেছিল। পুলিশ মিছিলটাতে এলোপাথারি গুলি বর্ষণ করে। ফলে রফিক, সালাম, বরকত সহ আরো নাম না জানা অনেকে শহীদ হন। ভাষার জন্য আর কোন জাতি রাজপথে এইভাবে বুকের রক্ত ঢেলে দেয়নি। তাই ২১ আমাদের গর্ব। শুধু আমাদের বলছি কেন ? পুরো পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের জন্য এই ঘটনা একটা দৃষ্টান্ত। তাই শহীদদের স্মৃতির স্মরণে আমাদের দেশের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের মানুষ ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করে শ্রদ্ধার সাথে। বল্টু সব শুনে বলল, কিন্তু একটা বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হলো না। আমরা বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি। যেদিন রাজপথে রক্ত দিয়েছি সেদিনের বাংলা তারিখটা না পালন করে আমরা ইংরেজি তারিখে মাতৃভাষা দিবস পালন করি কেন ? বল্টুর হাজারও অযুক্তিক প্রশ্নের মতো এই প্রশ্নটাকেও অযুক্তিক প্রশ্নের কাতারে ফেলে দিলাম। কিন্তু, সত্যিই কি ফেলে দিতে পেরেছি?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thanks.